ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি: এর তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া: অতঃপর ১৯৬৬ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা
কর্মসূচি অনুমোদন লাভ করে। ৫ দফা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরেই শেখ মুজিব ১৮ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী
লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ঐ প্রস্তাবগুলি ব্যাখ্যা সহকারে ‘আমাদের বাঁচার দাবি-৬ দফা’ কর্মসূচি জনগণের মধ্যে প্রচারার্থে পেশ
করেন। প্রস্তাবগুলির সার নিম্নে প্রদত্ত হয়:-
১। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়তে হবে।
তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে সরকার থাকবে। সকল নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাসমূহের
সার্বভৌমত্ব থাকবে।
২। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুইটি বিষয় থাকবে-প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয়
স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকবে।
৩। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে। অথবা
দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকবে। শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার
হতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। দুই অঞ্চলে দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
81 সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল
সরকারের সেই ক্ষমতা থাকবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর একটি অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হয়ে যাবে। এই মর্মে
রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকবে। এভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হবে।
৫। দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আদায়ের পৃথক হিসাব রাখতে হবে। এই অর্থে স্ব-স্ব আঞ্চলিক সরকারে
এখতিয়ার থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল সমানভাবে দেবে অথবা সংবিধানের নির্ধারিত হারে আদায়
হবে। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি রপ্তানির অধিকার আঞ্চলিক সরকারের থাকবে।
৬। বাংলাদেশের জন্য মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠন করা হবে এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে
বাংলাদেশ আত্মনির্ভর হবে। প্রকৃতপক্ষে সেই সময়ে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল পাকিস্তান দুই অঞ্চলের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর ও
পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্রতম অঞ্চলের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। শেখ মুজিবের ৬ দফা শোষিত ও নির্যাতিত বাঙালির নিকট তাদের
‘ম্যাগনাকার্টা’ বা মুক্তিসনদরূপে সর্বত্র অভিনন্দন লাভ করে। আওয়ামী লীগ রাতারাতি জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
৬ দফা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার এবং দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
সরকার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা দমননীতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দক্ষিণপন্থী দলগুলি ৬ দফার নানা অপব্যাখ্যা প্রদান করে
আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী রূপে চিহ্নিত করে জনমনকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পায়। তারা আওয়ামী লীগের নীতিকে জাতীয় সংহতির
পরিপন্থীরূপে প্রচার করে। এমনকি মওলানা ভাসানীর মতো জননেতাও ৬ দফার বিরূপ সমালোচনা করেন। অবশ্য ন্যাপের নিজস্ব ১৪ দফা কর্মসূচির মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন সহ অর্থনৈতিক ও রাজনীতিক মুক্তির জন্য বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল।
স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফার বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন। ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি
তিনি শেখ মুজিব ও তাঁর দলকে বিভেদকারী বলে অভিহিত করেন এবং তাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ ও গৃহযুদ্ধের হুমকি প্রদান করেন। প্রেসিডেন্টের ইঙ্গিতে তাঁর পুতুল গভর্নর মোনেম খান শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দায়ের করে তাদের হয়রানি ও নির্যাতন করেন। শেষ পর্যন্ত ৮ই মে রাত্রে শেখ মুজিব ও তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট সহকর্মীকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের বলে গ্রেফতার করা হয়। ৬ দফা সমর্থনকারী বিরোধী দলের অনেক নেতা ও কর্মীকে এই আইনে কারারুদ্ধ ও সরকারি নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের সংবাদে ঢাকা শহরে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি
জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ এর তীব্র নিন্দা করেন। ১৩ই মে এই ঘটনার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। অতঃপর ওয়ার্কিং কমিটি ৭ই জুন ৬ দফার দাবিতে সারা প্রদেশব্যাপী গণ-আন্দোলন ও এক সর্বাত্মক হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই ৭-ই জুন আন্দোলন নামে খ্যাত।