Home » গোধূলি সন্ধির নৃত্য- জীবনানন্দ দাশ

গোধূলি সন্ধির নৃত্য- জীবনানন্দ দাশ

by admin
গোধূলি সন্ধির নৃত্য- জীবনানন্দ দাশ


গোধূলি সন্ধির নৃত্য- জীবনানন্দ দাশ: গোধূলি সন্ধির নৃত্য জীবনানন্দ দাশের সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

ও. কে.

একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপো ভালোবেসেছিলো; একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে;

একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিলো;

তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিলো দশজন মূর্থের বিক্ষোভে।

বুকের উপরে হাত রেখে দিয়ে তা’রা

নিজেদের কাজ ক’রে গিয়েছিলো সব।

অবশেষে তা’রা আজ মাটির ভিতরে

অপরের নিয়মে নীরব।

মাটির আহ্নিক গতি সে-নিয়ম নয়;

সূর্য তার স্বাভাবিক চোখে

সে-নিয়ম নয়— কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়;

সব দিক ও. কে.।

সাবলীল

আকাশে সূর্যের আলো থাকুক না— তবু—

দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে।

আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই।

মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে।

মাঝে-মাঝে পুরুষার্থ উত্তেজিত হ’লে—

(এ রকম উত্তেজিত হয়;)

উপস্থাপয়িতার মতন

আমাদের চায়ের সময়

এসে প’ড়ে আমাদের স্থির হ’তে বলে।

সকলেই স্নিগ্ধ হ’য়ে আত্মকর্মক্ষম;

এক পৃথিবীর দ্বেষ হিংসা কেটে ফেলে

চেয়ে দ্যাখে স্তূপাকারে কেটেছে রেশম।

এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে

পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্ণকাল:

প্রতিটি রেশম থেকে সীতা তার অগ্নিপরীক্ষায়—

অথবা খ্রীষ্টের রক্ত করবী ফুলের মতো লাল।

মানুষ সর্বদা যদি

মানুষ সর্বদা যদি নরকের পথ বেছে নিতো—

(স্বর্গে পৌঁছুবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিলো ভুলে),

অথবা বিষম মদ স্বতই গেলাসে ঢেলে নিতো,

পরচুলা এঁটে নিতো স্বাভাবিক চুলে,

সর্বদা এ-সব কাজ ক’রে যেত যদি

যেমন সে প্রায়শই করে,

পরচুলা তবে কার সন্দেহের বস্তু হ’তো, আহা,

অথবা মুখোশ খুলে খুশি হ’তো কে নিজের মুখের রগড়ে।

চার্বাক প্রভৃতি—

‘কেউ দূরে নেপথ্যের থেকে, মনে হয়,

মানুষের বৈশিষ্ট্যের উত্থান-পতন

একটি পাখির জন্ম— কীচকের জন্মমৃত্যু সব

বিচারসাপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের

কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়।

তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে

মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’

ব’লে গেল বায়ুলোকে নাগার্জুন, কৌটিল্য, কপিল,

চার্বাক প্রভৃতি নিরীশ্বর;

অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা—

অবিরাম যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বায়ুর ভিতর।

সমুদ্রতীরে

পৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে

জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব

বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে

মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব।

এই সব বোধ হয় আজ এই ভোরের আলোর পথে এসে

জুহুর সমুদ্রপারে, অগণন ঘোড়া ও ঘেসেড়াদের ভিড়ে।

এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট্যাঁক, ধর্ম মরেছে;

তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।

গোধূলি সন্ধির নৃত্য- জীবনানন্দ দাশ

সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে।

এক সাথে বেরাল ও বেরালের-মুখে-ধরা-ইঁদুর হাসাতে

এমন আশ্চর্য শক্তি ছিলো ভূয়োদর্শী যুবার।

ইঁদুরকে খেতে-খেতে শাদা বেরালের ব্যবহার,

অথবা টুকরো হ’তে-হ’তে সেই ভারিক্কে ইঁদুর:

বৈকুণ্ঠ ও নরকের থেকে তা’রা দুই জনে কতোখানি দূর

ভুলে গিয়ে আধে আলো অন্ধকারে হেঁচকা মাটির পৃথিবীতে

আরো কিছুদিন বেঁচে কিছুটা আমেজ পেয়ে নিতে

কিছুটা সুবিধা ক’রে দিতে যেত— মাটির দরের মতো রেটে;

তবুও বেদম হেসে খিল ধ’রে যেত ব’লে বেরালের পেটে

ইঁদুর ‘হুর্‌রে’ ব’লে হেসে খুন হ’তো সেই খিল কেটে-কেটে।

এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে।

যদিও সে নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে

সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা

এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা

হৃদয়ে জাগায়ে যায়; টেবিলে বইয়ের স্তূপ দেখে মনে হয়

যদিও প্লেটোর থেকে রবি ফ্রয়েড নিজ-নিজ চিন্তার বিষয়

পরিশেষ ক’রে দিয়ে শিশিরের বালাপোশে অপরূপ শীতে

এখন ঘুমায়ে আছে— তাহদের ঘুম ভেঙে দিতে

নিজের কুলুপ এঁটে পৃথিবীতে— ওই পারে মৃত্যুর তালা

ত্রিবেদী কি খোলে নাই? তান্ত্রিক উপাসনা মিস্টিক ইহুদী কাবালা

ঈশার শবোত্থান— বোধিদ্রুমের জন্ম মরণের থেকে শুরু ক’রে

হেগেল ও মার্কস: তার ডান আর বাম কান ধ’রে

দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিলো; এমন সময়

দু-পকেটে হাত রেখে ভ্রূকুটিল চোখে নিরাময়

জ্ঞানের চেয়েও তার ভালো লেগে গেল মাটি মানুষের প্রেম;

প্রেমের চেয়েও ভালো মনে হ’লো একটি টোটেম:

উটের ছবির মতো— একজন নারীর হৃদয়ে;

মুখে-চোখে আকুতিতে মরীচিকা জয়ে

চলেছে সে; জড়ায়েছে ঘিয়ের রঙের মতো শাড়ি;

ভালো ক’রে দেখে নিলে মনে হয় অতীব চতুর দক্ষিণরাঢ়ী

দিব্য মহিলা এক; কোথায় যে আঁচলের খুঁট;

কেবলি উত্তরপাড়া ব্যাণ্ডেল কাশীপুর বেহালা খুরুট

ঘুরে যায় স্টালিন, নেহেরু, ব্লক, অথবা রায়ের বোঝা ব’য়ে,

ত্রিপাদ ভূমির পরে আরো ভূমি আছে এই বলির হৃদয়ে?

তা হ’লে তা’ প্রেম নয়; ভেবে গেল ত্রিবেদীর হৃদয়ের জ্ঞান।

জড় ও অজড় ডায়ালেকটিক মিলে আমাদের দু-দিকের কান

টানে ব’লে বেঁচে থাকি— ত্রিবেদীকে বেশি জোরে দিয়েছিলো টান।

গোধূলি সন্ধির নৃত্য- জীবনানন্দ দাশ

দরদালানের ভিড় — পৃথিবীর শেষে

যেইখানে প’ড়ে আছে– শব্দহীন— ভাঙা—

সেইখানে উঁচু-উঁচু হরিতকী গাছের পিছনে

হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল— রাঙা—

চুপে-চুপে ভুলে যায়— জ্যোৎস্নায়।

পিপুলের গাছে ব’সে পেঁচা শুধু একা

চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর

রুপার ডিবের মতে চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।

হরিতকী শাখাদের নিচে যেন হীরের স্ফুলিঙ্গ

আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাস;

নৃমুণ্ডের আবছায়া— নিস্তব্ধতা—

বাদামী পাতার ঘ্রাণ— মধুকূপী ঘাস।

কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো:

পুরুষ তাদের: কৃতকর্ম নবীন;

খোঁপার ভিতরে চুলে: নরকের নবজাত মেঘ,

পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ।

সেখানে গোপন জল ম্লান হ’য়ে হীরে হয় ফের,

পাতাদের উৎসরণে কোনো শব্দ নাই;

তবু তা’রা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে

বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।

সেইখানে যূথচারী কয়েকটি নারী

ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে

মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা

যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে।

প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের

তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে

স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে

ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে— বরুণে

ক্রূর পথ নিয়ে যায় হরিতকী বনে— জ্যোৎস্নায়।

যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন

শেষ হ’য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ,

পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক— কর্কট— তুলা— মীন।

You may also like

Leave a Comment

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ দেলোয়ার হোসেন

যোগাযোগঃ অফিসঃ ৪৩/বি, নবাবগঞ্জ বাজার, লালবাগ, ঢাকা-১২১১

মোবাইলঃ ০১৭১১৬৬৪৬৬৫

Email: info@janaojana.com

২০২৪ জানা-অজানা কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

অনুসরণ করুন