বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও বাংলার নদ-নদী: ভূ-প্রাকৃতিক গঠন বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলার পাঁচটি ভাগ ধরা যায়: উত্তর বাংলার পাললিক সমভূমি; ব্রহ্মপুত্র-
মেঘনা অন্তর্বর্তী ভূভাগ; ভাগীরথী-মেঘনা অন্তর্বর্তী ব-দ্বীপ; চট্টগ্রামের অনুচ্ছ পার্বত্য এলাকা এবং বর্ধমানাঞ্চলের অনুচ্চ পার্বত্য এলাকা।
বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নদীর। বাংলার বিস্তীর্ণ ভূভাগ নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত এবং পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব
বাংলার কিছু অংশ ছাড়া বাংলার প্রায় সবটাই ভূতত্ত্বের আলোকে নবসৃষ্ট (new alluvium) । পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিকের সীমান্তবর্তী
পর্বতমালা ছাড়া বাকি সবটাই সমতলভূমি এবং এই সমগ্র ভূ-ভাগই নদীমালার ব-দ্বীপ বা ‘ডেল্টা’ বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন।
ওল্ডহাম পশ্চিমে হুগলি নদী থেকে পূর্বে মেঘনা নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগকেই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীমালার ‘ডেল্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
যে বাংলার ভূমি গঠনের ভূ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে কোন্ অংশ মূলত ‘ডেল্টা’ সে বিষয়ে কে. বাগচী আরও তথ্য পরিবেশন করেন। বাঁকুড়া,
বর্ধমান, বীরভূম এবং মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশ, ছোট নাগপুর পর্বত শাখারই বিস্তৃতি, এই ভূ-ভাগের অন্তঃস্থলে কঠিন উপরিভাগে
সামান্য পলি; মেদিনীপুরের ‘পূর্বাংশ ‘পিডমন্ট’ (Piedmont) সমভূমি। উত্তরে তরাই অঞ্চল থেকে দক্ষিণে পদ্মার প্রবাহ এবং পশ্চিমে গঙ্গা-
পদ্মা থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত ভূ-ভাগ, কিংবা ব্রহ্মপুত্র-সুরমা অন্তর্বর্তী ভূ-ভাগ মূলত পাললিক প্রকৃতির, তবে অপেক্ষাকৃত প্রাচীন।
উত্তর-পূর্ব ও পূর্বে অবস্থিত সিলেট- ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম পর্বতমালা ‘টারশিয়ারী’ পাহাড়। উত্তরে পদ্মা, পশ্চিমে ভাগীরথী, পূর্বে মঘনা এবং
দক্ষিণে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ মূলত প্লাবন সমভূমি এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র গঠিত ব-দ্বীপ বা ‘ডেল্টা’।
বাংলার নদ-নদী: বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
‘বাংলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাংলার ছোট বড় অসংখ্য নদ-নদী। এই নদ- নদীগুলিই বাংলার প্রাণ, ইহারাই বাংলাকে গড়িয়াছে,
নদী বাংলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনও করিতেছে।’ নীহাররঞ্জন রায়ের এই উক্তিতে বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে নদীর গুরুত্ব
স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রধান নদীগুলির স্রোতধারাই বাংলাকে মূলত চারটি বিভাগে বিভক্ত করেছে: উত্তর, পশ্চিম, মধ্য ও পূর্বভাগ।
প্রত্যেকটি ভাগেরই যেমন রয়েছে নিজ নিজ ভৌগোলিক সত্তা, তেমনি রয়েছে ঐতিহাসিক সত্তা। এছাড়া নদীর ক্রমপরিবর্তমান রূপ অর্থাৎ
যুগে যুগে নদীর খাত পরিবর্তিত হওয়া, পুরোনো নদী মজে যাওয়া, নতুন নদীর সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে সমভূমিতে নদীর
এই প্রক্রিয়া অধিকতর বলে অনেকেই মনে করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রেনেলের, সপ্তদশ শতাব্দীতে ফান্ ডেন ব্রোকের এবং ষোড়শ
শতাব্দীতে জাও দ্য ব্যারোসের নক্শায় বাংলার নদ-নদীগুলির গতিপথ অনেকটা স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে।
বলা যায় বাংলার নদ-নদীর মধ্যে গঙ্গাই প্রধান। বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
রাজমহল পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিমে তেলিগড় ও সিক্রিগলি সংকীর্ণ গিরিপথই উত্তর ভারত থেকে গঙ্গার বাংলায় প্রবেশপথ এবং গিরিপথ
ছেড়ে রাজমহলকে স্পর্শ করে গঙ্গা বাংলার সমতলভূমিতে প্রবেশ করেছে। সমতলভূমিতে যাত্রা শুরু করেই গঙ্গার দুটি প্রধান প্রবাহ লক্ষ
করা যায়-একটি পূর্ব- দক্ষিণগামী, নাম পদ্মা; অন্যটি সোজা দক্ষিণমুখী, নাম ভাগীরথী। মুর্শিদাবাদ জেলায় সুতি থানার ছবঘাটির নিকটেই
বর্তমান গঙ্গা দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। ভাগীরথী বর্তমানে জঙ্গীপুর, লালবাগ, কাটওয়া, নবদ্বীপ ও কোলকাতার পাশ দিয়ে ডায়মণ্ড হারবারের
নিকটে সমুদ্রে পড়েছে। পদ্মা বর্তমানে গঙ্গার মূল প্রবাহ, পূর্ব-দক্ষিণগামী হয়ে বাংলাদেশের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং চাঁদপুরের
নিকটে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে জলপ্রবাহ উৎসারিত করছে।
জলবিজ্ঞানের (Hydrography) দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগীরথীই গঙ্গার প্রথম ও আদি প্রবাহ বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে।
রেনেলের মানচিত্রে ভাগীরথী নদী জঙ্গীপুর, মুর্শিদাবাদ, কাসিমবাজার বুরহামপুর, পলাশী, কাটওয়া, নুদিয়া, মির্জাপুর, বাঁশবাড়িয়া, হুগলি,
চন্দননগর, সেরামপুর, কোলকাতা, বজবজ ও ফল্লা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে (১৪৯৫) ভাগীরথীর
প্রবাহের সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। মোটামুটিভাবে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভাগীরথীর গতিপথ কোলকাতা পর্যন্ত খুব
একটা বদলায়নি। কিন্তু সমুদ্রে উৎসারিত হওয়ার প্রবাহ বিভিন্ন ছিল।
নীহাররঞ্জন রায় ভাগীরথীর গতিপথের তিনটি পর্যায়ের কথা বলেছেন: বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
(১) প্রাচীনতম রাজমহল পার হয়ে সাওতালভূমি, ছোটনাগপুর, মানভূম, ধলভূম হয়ে সোজা দক্ষিণে পতিত হতো। এই প্রবাহের সঙ্গেই
অজয়, দামোদর এবং রূপনারায়ণ এসে মিলতো। এই প্রবাহের দক্ষিণতম সীমায় ছিল ‘তাম্রলিপ্তি’ বন্দর। (২) বর্তমান কালিন্দী-মহানন্দা
খাতে প্রবাহিত হয়ে গৌড়কে ডানে রেখে পরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাহিনী হয়ে প্রথম পর্যায়ের খাতের কিছু পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত
হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর আগেই এই পরিবর্তন ঘটে। (৩) এই পর্যায়ে ‘তাম্রলিপ্তি’ পরিত্যক্ত- অর্থাৎ পশ্চিমতর প্রবাহ পরিত্যক্ত-কোলকাতা
বেতড় পর্যন্ত ভাগীরথীর বর্তমান প্রবাহ পথ এবং বেতড়ের দক্ষিণে আদিগঙ্গা পথের প্রবর্তন হয়। আদিগঙ্গা পরিত্যক্ত হওয়ার পর আবার
পুরানো সরস্বতী খাতে ভাগীরথীকে প্রবাহিত করা হয়। গঙ্গার অন্য প্রবাহ-পদ্মা, কৃত্তিবাসের বড় গঙ্গা।
রেনেলের মানচিত্রে বা ফান ডেন্ ব্রোকের মানচিত্রে পদ্মাকেই গঙ্গার মূল প্রবাহ বলে মনে হয়।
এই সময়ে ভাগীরথীকে ক্ষীণ দেখানো হয়েছে। কৃত্তিবাস সূত্রে দেখা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীতেও পদ্মা ছিল গঙ্গার মূল প্রবাহ। আবুল ফজলও
পদ্মাকে গঙ্গার প্রবাহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইবনে বতুতা, ‘রামচরিত’ কাব্য, শ্রীচন্দ্রের ইদিলপুর তাম্রশাসন (‘সতট পদ্মাবতী’ বিষয়),
ফান ডেন্ ব্রোক ও রেনেলের মানচিত্র, দ্য ব্যারোস প্রমুখ সূত্রেও পদ্মার প্রবাহ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। রেনেলের জরিপকালে
(১৭৬৪-৭৭) পদ্মা জাফরগঞ্জের কাছে আত্রেয়ী ও করতোয়ার মিলিত স্রোত এবং যমুনার সঙ্গে মিলিত হতো এবং দক্ষিণাভিমুখে প্রবাহিত
হয়ে চাঁদপুরের প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত দক্ষিণ শাহবাজপুরের দ্বীপের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে সাগরের দিকে প্রবাহিত
হতো। ফান ডেন্ ব্রোকের মানচিত্রে (১৬৬০) পদ্মার স্রোতকে ফরিদপুর এবং বাখরগঞ্জের পশ্চিমে দেখানো হয়েছে।
হয়তো তখন গড়াই-মধুমতী প্রবাহই পদ্মার প্রধান প্রবাহ ছিল।
শতাব্দীকাল পূর্বে দ্য ব্যারোসের নক্শা অনুসারে পদ্মার প্রবাহ রামপুর ধলেশ্বরী ও ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার খাত ধরে ঢাকা পার হয়ে মেঘনায়
গিয়ে মিশতো। গঙ্গা-পদ্মা প্রবাহ বাংলার ভূ-প্রকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এই প্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে আরও অনেক নদ-নদী। বিস্তীর্ণ
সমতল ভূমির উপর প্রবাহকালে নদীর গতি পরিবর্তন যেমন স্বাভাবিক তেমনি নতুন নতুন প্রবাহ দ্বারা শাখা নদী সৃষ্টি করাও স্বাভাবিক বলে
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এককালের ভৈরব প্রবাহ তেমনি একটি শাখা নদী।
রামপুর বোয়ালিয়ার কাছে পদ্মা থেকে নির্গত হয়ে দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত হয়ে হরিণঘাটা মোহনায় সাগরে পড়তো। এখন অবশ্য জেলঙ্গী ও
মাথাভাঙ্গা ভৈরবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একে তিন ভাগে ভাগ করেছে। মাথাভাঙ্গা, কুমার, নবগঙ্গা ও তিস্তা এমনি পদ্মার শাখা নদী।
ভাগীরথীর শাখা নদীসমূহের মধ্যে যমুনা এককালে বিশাল ছিল। কিন্তু বর্তমানে একে খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর। রেনেলের মানচিত্রে যমুনা
অত্যন্ত ক্ষীণ। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে যমুনা ত্রিবেনী সঙ্গমের অন্যতম নদী ছিল (যমুনা-গঙ্গা-সরস্বতী)।
পঞ্চদশ শতাব্দীর পরে কোন এক সময় যমুনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে এবং রেনেলের সময়ে অতি ক্ষীণ একটি প্রবাহে পরিণত হয়েছে
বলে অনুমান করা যায়। বাংলার নদীসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান প্রবাহ ব্রহ্মপুত্র বাংলার উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিব্বতের মানস-সরোবরে এর উৎপত্তি, প্রথমে মোটামুটি পূর্বগামী এবং দক্ষিণ দিকে বাঁক দিয়ে আসামে প্রবেশ করছে।
আসামের ভেতর দিকে গতিপথ কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমগামী এবং রংপুর ও কুচবিহারের সীমান্ত দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করছে। বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
বাংলা পর্যন্ত পৌঁছাতে ব্রহ্মপুত্রকে (প্রাচীন নাম লৌহিত্য) প্রায় ১৮০০ মাইল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র বেশ কয়েকবার
গতিপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনা-পদ্মার পথে চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়ছে। গারো পাহাড় পর্যন্ত লৌহিত্যের
গতি পরিবর্তনের তেমন কোন প্রমাণ নেই। গারো পাহাড়ের পূর্ব-দক্ষিণ ভাগ ঘেঁষে দেওয়ানগঞ্জের পাশ দিয়ে শেরপুর-জামালপুরের ভেতর
দিয়ে মধুপুর গড়ের পাশ দিয়ে ময়মনসিংহ জেলাকে দ্বিধাবিভক্ত করে ঢাকার পূর্বাঞ্চল দিয়ে সোনারগাঁয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে লাঙ্গলবন্ধের
পাশ দিয়ে ধলেশ্বরীতে প্রবাহিত হতো ব্রহ্মপুত্রের একটি প্রবাহ।
যেহেতু এই প্রৱাহকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের ধর্মীয় পবিত্রতার ধারণা গড়ে উঠেছে তাই এটিকেই ব্রহ্মপুত্রের
প্রাচীন ধারা বলে মনে করা হয়। বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বেই কোন এক সময়ে ব্রহ্মপুত্রের এই প্রবাহ (পূর্বতম) ঢাকা জেলায় পৌঁছার পূর্বেই ভৈরব বাজারের নিকট উত্তর দিক
থেকে আগত সুরমা-মেঘনা জলধারার সঙ্গে মিশেছে। ভৈরব বাজার থেকে সমুদ্র পর্যন্ত এই ধারাকেই রেনেলের মানচিত্রে মেঘনা বলে
দেখানো হয়েছে। রেনেল-পরবর্তী কোন সময়ে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর কোন সময়ে ব্রহ্মপুত্রের প্রধান প্রবাহ হয়েছে বর্তমানের যমুনা,
বগুড়া-পাবনার পূর্বসীমা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনাই ব্রহ্মপুত্রের বিপুল জলরাশি গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা- প্রবাহে এনে ফেলছে। বাংলার
পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীপ্রবাহ মেঘনা, গঙ্গা-পদ্মা বা ব্রহ্মপুত্রের তুলনায় মেঘনা ছোট নদী। তবে এই নদী শিলং মালভূমি ও সিলেট অঞ্চলের
জলসম্ভারকে নিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। একথা মনে রাখতে হবে যে, উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকার পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব এই নদীর।
খাসিয়া-জয়ন্তিয়া শৈলমালা থেকে মেঘনার উদ্ভব, উত্তর প্রবাহে এর নাম সুরমা। সুরমার প্রাথমিক গতি পশ্চিমাভিমুখে
মাকুলির নিকটে দক্ষিণ গতি ধারণ করে সুরমা পরিচিত হয় মেঘনা নামে।
সিলেট জেলা পার হয়ে নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের পূর্ব সীমা স্পর্শ করে আজমিরিগঞ্জ বাম তীরে রেখে ভৈরব বাজারের নিকট
ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে তা মিলিত হয়েছে। দক্ষিণ দিকে সমুদ্রাভিমুখে যাত্রায় মেঘনা নামটি লোপ পায়নি। এটা মেঘনার সৌভাগ্য। রেনেলের
মানচিত্রে মেঘনার যে প্রবাহ দেখানো হয়েছে তাও বদলায়নি বলেই মনে হয়। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইবনে বতুতা সোনারগাঁও থেকে
সিলেট যাওয়ার সময়ে এই নদী পথেই ভ্রমণ করেছিলেন এবং তাঁর বর্ণনায় নদীর দুই ধারে ঘনবসতিময় গ্রাম-বাজারের উল্লেখ আছে। প্রধান
নদীসমূহের বিবরণের পর আঞ্চলিক নদীসমূহের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ অপ্রাসংগিক হবে না। বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে সরস্বতী ছাড়া অন্য কয়টি
নদীরই ছোটনাগপুর পার্বত্যাঞ্চল থেকে উৎপত্তি।
এদের মধ্যে অজয়, দামোদর, কাঁসাই, দ্বারকেশর ও রূপনারায়ণ উল্লেখের দাবি রাখে।
তাদের মধ্যে কাঁসাই সম্ভবত কালিদাসের রঘুবংশে বর্ণিত কপিশা। উত্তর বাংলার সুগঠিত ভূ-ভাগে বেশ কয়েকটি নদীর অস্তিত্ব রয়েছে।
এদের মধ্যে তিস্তার নাম প্রথমেই করতে হয়। ভুটান সীমান্তের উত্তরে হিমালয় হতে উৎসারিত হয়ে দার্জিলিং জলপাইগুড়ির ভিতর দিয়ে
তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জলপাইগুড়ি থেকেই তিস্তার তিনটি দক্ষিণবাহী প্রবাহঃ পূর্ব স্রোতের নাম করতোয়া, মধ্যবর্তী স্রোেতধারা
আত্রাই এবং পশ্চিম স্রোত পূর্ণভবা বা পুনর্ভবা। রেনেলের মানচিত্রে তিস্তার এই তিনটি স্রোতই দেখানো হয়েছে। তিন স্রোতে প্রবাহিত
বলেই এর নাম সম্ভবত ‘ত্রিস্রোতা তিস্তা’।
উত্তর বাংলার সুপ্রাচীন তীর্থ মহিমা খ্যাত পুণ্যতোয়া নদী করতোয়া।
বর্তমানে করতোয়া মৃতপ্রায় ক্ষীণপ্রবাহ। ফান ডেন্ ব্রোকের নক্শায়ও করতোয়ার বিশাল প্রবাহ দেখানো হয়েছে। মির্যা নাথান বলেছেন,
বর্ষাকালে এ নদী অনতিক্রমণীয়। ‘রামচরিত’ কাব্য, চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং (য়ুয়ান চোয়াং) এবং ‘করতোয়া মাহাত্ম্য’ গ্রন্থে এ নদীর
প্রবাহ ও তীর্থমহীমার কথা বলা হয়েছে। উত্তর বাংলার অন্য দুটি নদী আত্রাই ও পুনর্ভবা। তাদের বর্তমান রূপও করতোয়ার মতো ক্ষীণ। খুব
সম্ভবত ১৭৮৭-এ বন্যায় তিস্তা গতি পরিবর্তন করায় হিমালয় থেকে আগত জলরাশি করতোয়া, আত্রাই এবং পুনর্ভবা আর পেতো না; তাই
হয়তো এরা এখন মৃতপ্রায়। বাংলার নদীমালার আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, নদী বাংলার ভূ-প্রকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।
নদীর গতিপথ নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি।
প্রাচীন গ্রীক ও লাতিন লেখনিতে গঙ্গার অববাহিকায় যে ‘গঙ্গারিডাই’ রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা ‘গঙ্গা হৃদয়’ এর রূপান্তর বলে
অনুমান করা হয়েছে। ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী ভূভাগ ‘গঙ্গা হৃদয়’ বলে পরিচিত হবে এমন অনুমান করা খুব অযৌক্তিক নয়। এই
গ্রীক-লাতিন নাম হয়তো বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে নদীর গুরুত্বের কথাই প্রমাণ করে এবং এই গুরুত্ব সুপ্রাচীনকালেই স্বীকৃতি পেয়েছিল বলে
ধরা যেতে পারে।