বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীগুলোর নাম পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদ, মাতামুহূরী, সংগুসহ আরও অনেক নদী।
নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ”বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা” শীর্ষক গ্রন্থের তথ্যমতে শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ১,০০৮ টি নদ-নদী রয়েছে।
পদ্মা নদী:
উৎপত্তিস্থল ভারতের হিমালয় পর্বতমালার গঙ্গোত্রী হিমবাহে।
এই হিমবাহ থেকে বেরিয়ে আসা দুটি নদী, ভাগীরথী এবং অলকানন্দা, কোশি নদীতে মিলিত হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়।
এই নদীটি ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য ২৫৯৭ কিলোমিটার। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের বৃহত্তম নদী।
উত্তর ও দক্ষিণ মেরু ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও হিমালয়ের মতো এত বরফ নেই।
সঞ্চিত এই বরফের আচ্ছাদন হিমবাহ হয়ে নেমে এসে সৃষ্টি করেছে অনেক নদ-নদী।
ভারতের উত্তরাখন্ডে আছে এমনই এক বিশাল হিমবাহ।
এই হিমবাহ থেকে বেরিয়ে এসেছে পাঁচটি শীর্ষ ধারা—ভাগীরথী, অলকানন্দা, মন্দাকিনী, ধৌলীগঙ্গা ও পিণ্ডারী।
রুদ্রপ্রয়াগের কাছে মন্দাকিনী এসে অলকানন্দার সঙ্গে মিশেছে। ধৌলীগঙ্গা ও পিণ্ডারীও এসে অলকানন্দার সঙ্গে মিশেছে।
এই চার প্রবাহ অলকানন্দা নামে প্রবাহিত হয়ে দেবপ্রয়াগে এসে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশে গঙ্গা নাম ধারণ করেছে।
এই প্রবাহ হিমালয়ের গিরিসংকুল প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে হৃষীকেশ নামক স্থানে সমতলে নেমেছে।
উৎপত্তিস্থল থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের আগপর্যন্ত প্রবাহপথের উভয় দিক থেকে আসা বহু নদ–নদীর দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে গঙ্গা। বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর গঙ্গা দক্ষিণ-পূর্বমুখী পথে অগ্রসর হয়েছে।
এভাবে প্রায় ১০৫ কিলোমিটার পথ বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা চিহ্নিত করে গঙ্গা বয়ে গেছে।
বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে পদ্মা নামে পরিচিতি পেয়েছে গঙ্গা। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এই ধারা গোয়ালন্দ পর্যন্ত গঙ্গা অর্থাৎ বাংলাদেশের অংশটিই গঙ্গার মূলধারা। ভাগীরথী গঙ্গার শাখানদী।
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ :
শহর রাজশাহী এই পদ্মার উত্তর তীরে অবস্থিত। বাংলাদেশে নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার (নদী রক্ষা কমিশন রিপোর্ট ২০২৩) [২] গড় প্রস্থ ১০ কিলোমিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক পদ্মা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর
উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং ৩২।[৩] রাজা রাজবল্লভের কীর্তি পদ্মার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে ধ্বংস হয় বলে পদ্মার আরেক নাম হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদী রাজশাহী জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে,
এখান থেকে নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করেছে।
গঙ্গার অন্য শাখাটি ভাগীরথী নামে ভারতে হুগলীর দিকে প্রবাহিত হয়। উৎপত্তিস্থল হতে ২২০০ কিলোমিটার দূরে গোয়ালন্দে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে
আরও পূর্ব দিকে চাঁদপুর জেলায় মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। সবশেষে পদ্মা-মেঘনার মিলিত প্রবাহ মেঘনা নাম ধারণ করে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়কীর্তিনাশা।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রম করার পর তালবাড়িয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্বগামী হয়েছে গঙ্গা এবং একাধিক বাঁক নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পৌঁছেছে।
এখানে উত্তর দিক থেকে যমুনা এসে গঙ্গার সঙ্গে মিলে পদ্মা নাম ধারণ করেছে।
১২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলে মেঘনা নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
গঙ্গা ও পদ্মার মোট দৈর্ঘ্য ২৪৮০ কিলোমিটার।
গঙ্গা বাংলাদেশ অংশে ঠুঠাপাড়া মনোহরপুর থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত ২৪০ কিলোমিটার। এরপর পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার।
বাংলাদেশে গঙ্গা ও পদ্মা:
নদীর বহু শাখানদী আছে, এ দেশের যেকোনো নদ-নদীর শাখার তুলনায় যা অনেক বেশি।
বাংলাদেশে গঙ্গা ও পদ্মা থেকে নির্গত শাখানদীগুলো হচ্ছে মাথাভাঙ্গা, হিসনা, গড়াই বা গৌড়ী,
হরাই, চন্দনা ভুবনেশ্বর, কীর্তিনাশা, পাগলা, মরিগঙ্গা বা ফাঁড়ি, স্বরমঙ্গলা বা জামদহ, চিনারকুপ, নবগঙ্গা, বারাহী, স্বরমঙ্গলা বা
রাইচান, নারোদ, বড়াল, চন্দনা (চারঘাট), খলিশডাঙ্গা, ইছামতী (লালপুর), কমলা, রতনাই, ইছামতী (পাবনা) ও বাদাই।
বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীগুলোর নাম:
গঙ্গা ও পদ্মার গতিপ্রকৃতি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। ভূগোলবিদ ও নদীবিশেষজ্ঞদের মতে, আদি গঙ্গা ভাগীরথীর প্রবাহপথ দিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ত পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রাকৃতিক কোনো কারণে গঙ্গা তার প্রধান প্রবাহপথ ভাগীরথী ত্যাগ করে দক্ষিণ-পূর্বমুখী পথে অপেক্ষাকৃত আরেকটি ক্ষীণ ধারাকে অবলম্বন করে প্রবাহিত হতে শুরু করে।
প্রথমাবস্থায় ভৈরব নদের ধারাটি ছিল সবল।
এরপর মাথাভাঙ্গা, পরে কুমার এবং ভুবনেশ্বরের খাত দিয়েও গঙ্গার অধিকাংশ পানি প্রবাহিত হয়েছে।
গঙ্গা ও পদ্মা গত ছয় শ বছরে এভাবে একাধিকবার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। ১৭৮৭ সালে যমুনা নদী সৃষ্টির প্রায় ৩০ বছর পর
গঙ্গার মূলস্রোত গোয়ালন্দ থেকে বর্তমান প্রবাহপথটি বেছে নিয়েছে। বহু শাখা–প্রশাখার সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছে বৃহৎ গাঙ্গেয় বদ্বীপ। এর মোহনাজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন।
গঙ্গা ও পদ্মার:
অববাহিকায় গড়ে ওঠা জনপদগুলোয় বহু ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতির আলোকে গড়ে তুলেছে পৃথক পৃথক পরিমণ্ডল।
গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্যে গড়ে ওঠা মানববসতির পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস, শিল্পসংস্কৃতি, রাজনীতি, বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ধর্মীয় আচার ইত্যাদির সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য অববাহিকায় বসবাসরত মানবগোষ্ঠীর তুলনা চলে না।
গঙ্গা-পদ্মা-ভাগীরথী–হুগলি অববাহিকায় বিগত দুই হাজার বছরে ঘটে যাওয়া শত শত সামরিক তৎপরতার ঘটনা এ অঞ্চলের ইতিহাসকে এক ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো নদীতীরবর্তী অঞ্চলে গঙ্গার মতো এত অধিকসংখ্যক প্রাচীন নগর-বন্দর গড়ে ওঠেনি।
এগুলোর অনেকগুলো আবার বিভিন্ন শাসনামলে রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিল, যেমন পান্ডুয়া, গৌড়, তান্ডা, রাজমহল ও মুর্শিদাবাদ।
ভারত ও বাংলাদেশে গঙ্গাতীরবর্তী উর্বর ভূমিতে বাস করে ৫০ কোটির বেশি মানুষ।
বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা অববাহিকার বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী অঞ্চল।
মেঘনা নদী:
মেঘনা নদী বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদী এবং পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর অন্যতম।
মূলত মেঘনা হিমালয় বলয় বহির্ভূত (Non-Himalayan) নদী। সুরমা নদী আজমিরীগঞ্জের ভাটি থেকেই কোন কোন ক্ষেত্রে মেঘনা নামে পরিচিত।
সুরমা-মেঘনা নদীপ্রবাহ মদনা নামক স্থানের পরে প্রায় ২৬ কিমি ভাটিতে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের কাছে ধলেশ্বরী নাম ধারণ করে।
উত্তরের অংশে ধলেশ্বরী নদী অত্যন্ত ভাঙনপ্রবণ এবং দিক পরিবর্তনশীল।
নদীর এই নামকরণ মেঘনা নামের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তিকর।
এই অসুবিধা দূর করার জন্য আজমিরীগঞ্জের ভাটিতে মূল প্রবাহ যেখানে ধনু এবং ঘোড়াউত্রা নদীর মিলিত স্রোতের সঙ্গে মিশেছে, সে পর্যন্ত নদীটির নাম সুরমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এই স্থানটি কুলিয়ারচরের ৫ কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত। এই সঙ্গম স্থলের পর থেকেই নদীটি মেঘনা নামে পরিচিত।
মূলত মেঘনা নদী দুটি অংশে বিভক্ত। কুলিয়ারচর থেকে ষাটনল পর্যন্ত আপার মেঘনা।
নদীর এই অংশ অপেক্ষাকৃত ছোট। ষাটনল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত অংশ লোয়ার মেঘনা নামে পরিচিত।
এই অংশে নদী বিশাল এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মোহনার অধিকারী।
এই লোয়ার মেঘনা দেশের অন্য দুটি প্রধান নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানিও সাগরে বয়ে নিয়ে যায়।
বিশালত্বের কারণে মেঘনার এই অংশ একটি স্বতন্ত্র নদী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
প্রবাহ পথে মেঘনা থেকে ছোট ছোট বিভিন্ন শাখা বেরিয়ে ত্রিপুরার বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর পানি বহন করে পুনরায় মেঘনাতে পড়েছে।
এগুলোর মধ্যে তিতাস, পাগলী, কাঠালিয়া, ধনাগোদা, মতলব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মেঘনা নদী স্বয়ং এবং এর উল্লিখিত শাখা-প্রশাখা ত্রিপুরার বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে পানি পেয়ে থাকে।
উল্লেখযোগ্য পাহাড়ি নদীগুলো হচ্ছে- গোমতী, হাওড়া, কাগনী, সোনাইবুড়ি, হরিমঙ্গল, কাকড়াই, কুরোলিয়া, বালুজুড়ি, সোনাইছড়ি, হান্দাছড়া, জঙ্গলিয়া ও ডাকাতিয়া। এই নদীগুলো সংগত কারণেই বন্যাপ্রবণ।
বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীগুলোর নাম:
ভৈরব বাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী এবং এর কিছু ভাটিতে ষাটনলের কাছে ধলেশ্বরী নদী আপার মেঘনার সঙ্গে মিশেছে।
এখানে আড়াআড়িভাবে মেঘনার বিস্তৃতি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মেঘনার উপরের অংশ পূর্বদিক থেকে ত্রিপুরার পাহাড়ি নদীর পানি প্রবাহ, আর পশ্চিমে ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানি দ্বারা সমৃদ্ধ হয়।
ষাটনলের কাছে পূর্বদিক থেকে আসা মেঘনার পানি স্বচ্ছ ও নীল, আর পশ্চিম থেকে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর পানি ঘোলা। এই দুই নদীর ধারা নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, নদীর অর্ধেক অংশ স্বচ্ছ ও নীল (পূর্ব দিকের অংশ) এবং অপর অর্ধাংশে ঘোলা পানি, কেউ কারও সঙ্গে না মিশে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে।
ষাটনলের ১৬ কিমি ভাটিতে চাঁদপুরের কাছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মিলিত স্রোত পদ্মা নামে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
এখান থেকেই নদীটি বিশাল আকৃতি ধারণ করে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে এবং এই সঙ্গম স্থলের ভাটির অংশই লোয়ার মেঘনা নামে পরিচিত। এখানে নদীর বিস্তৃতি প্রায় এগারো কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬০ কিমি।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদী মেঘনা মূলত সুরমা, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও গঙ্গার মিলিত স্রোতধারা। মেঘনার নিম্নাংশে অর্থাৎ লোয়ার মেঘনাতে প্রচুর চর গঠিত হয়েছে। এখানে মেঘনার তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়, এগুলো হচ্ছে- ইলশা বা তেঁতুলিয়া, শাহবাজপুর এবং বামনী। তেঁতুলিয়া নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার বিস্তৃত। এটি ভোলাকে বরিশালের মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। নদীর এই অংশেরই পশ্চিম মুখে রামনাবাদ দ্বীপ অবস্থিত। শাহবাজপুরের বিস্তৃতি প্রায় আট কিলোমিটার। এটি ভোলাকে রামগতি এবং হাতিয়া দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
বামনী :
একসময় রামগতি ও চরলক্ষ্যা দ্বীপের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হতো এবং এটিই ছিল লোয়ার মেঘনার মূলধারা। কিন্তু বর্তমানে এর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
মেঘনা অত্যন্ত গভীর এবং নাব্য একটি নদী। সারা বছরই নদীতে নৌচলাচল সম্ভব হয়। ছোটবড় নৌকা এবং স্টিমার প্রায় সারা বছরই এই নদী পথে যাতায়াত করে। বর্ষা মৌসুমে নারায়ণগঞ্জ জেলার বৈদ্যেরবাজার পর্যন্ত মেঘনাতে জোয়ারভাটার প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। শুকনো মৌসুমে এই জোয়ারভাটা রেখা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মারকুলি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। ষাটনল, চাঁদপুর, দৌলতখান এবং চর তজুমুদ্দিনে মেঘনা নদীর পানি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে লবণাক্ততা নিরূপণ করা হয়।
মেঘনা নদীর পানিসমতল উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কানাইর হাট, সিলেট, ছাতক, সুনামগঞ্জ, মারকুলি, আজমিরীগঞ্জ, মদনা, অষ্টগ্রাম, ভৈরব বাজার,
নরসিংদী, বৈদ্যেরবাজার, ষাটনল, চাঁদপুর, দৌলতখান এবং চর তজুমুদ্দিনে পানি সমতল গেজ আছে।
ভৈরব বাজারে সর্বোচ্চ ৭.৬৬ মিটার এবং সর্বনিম্ন ০.৮৮ মিটার সমতল লক্ষ্য করা গেছে।
সিলেট এবং ভৈরব বাজারে মেঘনা নদীর পানি প্রবাহের পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
ভৈরব বাজারে প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ১৯,৪৮৫ ঘনমিটার এবং সর্বনিম্ন ৬,৬২৭ ঘনমিটার পানি প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশে সুরমা-মেঘনার :
মোট দৈর্ঘ্য ৬৭০ কিলোমিটার। নদীটির উপরের অংশ (আপার মেঘনা) নিম্নাংশের (লোয়ার মেঘনা) চেয়ে অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ।
ভৈরব বাজারে নদীর বিস্তার প্রায় এক কিলোমিটার, ষাটনলের কাছে পাঁচ কিলোমিটার এবং চাঁদপুরের কাছে এগারো কিলোমিটার।
মোহনায় ইলশা বা তেঁতুলিয়া এবং শাহবাজপুরের একত্রে বিস্তৃতি প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
রামনাবাদ থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ১৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকাকে মেঘনার মোহনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
সুরমা-মেঘনার উভয় তীরে বহু জনপদ, শহর, বন্দর, কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। সেগুলোর মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা প্রভৃতি জেলা শহর উল্লেখযোগ্য।
নৌ ও বাণিজ্য বন্দর হিসেবে মারকুলি, আজমিরীগঞ্জ, মদনা, কুলিয়ারচর, ভৈরব বাজার, চাঁদপুর (পুরান বাজার), রামদাসপুর, কালুপুর, দৌলতখান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
আশুগঞ্জ তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা এই নদীর তীরে অবস্থিত।
হাওর এলাকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা বন্যাপ্রবণ একটি নদী।
বর্ষার শুরুতেই হাওর এলাকা বৃষ্টির পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
হাওরের এই সঞ্চিত পানির সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন পাহাড়িয়া নদী থেকে প্রাপ্ত প্রবাহ এবং সুরমা-মেঘনা নদী এই বিপুল জলরাশি যথাযথরূপে ধারণ করতে না পারার ফলে
নদীর তীর উপচিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে।
নদীর ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত এই পানির কারণে প্রতি বছর বর্ষার শুরুতেই অকাল প্লাবন দেখা দেয় এবং জনমানব, গবাদিপশু ও কৃষি ফসলের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক মেঘনা উপত্যকা পরিকল্পনা এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম পরিকল্পনা নামে দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল।
এর মধ্যে মেঘনা উপত্যকা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে।
এই পরিকল্পনায় মেঘনা নদীর পার্শ্বে বাঁধ নির্মাণ করে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং নদীর উপর আড়-বাঁধ দিয়ে প্রায় ১,৮০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
কুমিল্লা-চট্টগ্রাম পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ করে কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম জেলার প্রায় ৪০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান সম্ভব হবে।
উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১২৫ কিমি নদীর তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যার অংশবিশেষ মেঘনা তীরের অন্তর্ভুক্ত।
এই বেড়িবাঁধের সাহায্যে ঐসব এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও লবণাক্ততারোধ করে কৃষি সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়েছে।
এই বেড়িবাঁধগুলো ভূমি পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হবে।
যমুনা নদী:
যমুনা নদী ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের দীর্ঘতম নদীসমূহের মধ্যে অন্যতম।
তিববত, চীন, ভারত এবং বাংলাদেশের ভূখন্ড জুড়ে রয়েছে এর অববাহিকা অঞ্চল।
প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মপুত্র নদের নিম্ন প্রবাহ যমুনা নামে অভিহিত।
১৭৮২ থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যে সংঘটিত ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যার ফলে ব্রহ্মপুত্রের তৎকালীন গতিপথ
পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান কালের যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়।
জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদ তার পুরানো গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণাভিমুখী যমুনা নদী নামে প্রবাহিত হয়ে আরিচায় গঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
প্রবাহ প্রত্যাহারের ফলে দক্ষিণপূর্বাভিমুখী ব্রহ্মপুত্রের পুরানো প্রবাহটি শীর্ণকায় হয়ে পড়ে এবং অদ্যবধি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবাহমান রয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগ ব্রহ্মপুত্রের বর্তমান সমগ্র প্রবাহকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নামে অভিহিত করে থাকে।
তিববতের মানস সরোবর
এবং কৈলাস পর্বতের মধ্যবর্তী পার্খা নামক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে ১৪৫ কিমি অদূরে অবস্থিত চেমায়ুং-দুং নামক হিমবাহ (৩১°৩০´ উত্তর এবং ৮০°২০´ পূ) থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি।
সুবিশাল বঙ্গীয় সমভূমিতে পতিত হওয়ার পূর্বে আসামে ব্রহ্মপুত্র নদ ডিহাং নামে অভিহিত।
কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গঙ্গা নদীর সঙ্গে সঙ্গমের পূর্ব পর্যন্ত সাংপো-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৭০০ কিমি।
বাংলাদেশ ভূখন্ডে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার দৈর্ঘ্য ২৭৬ কিমি যার মধ্যে যমুনা নদীর দৈর্ঘ্য ২০৫ কিমি।
নদীটির প্রশস্ততা ৩ কিমি থেকে ২০ কিমি পর্যন্ত, তবে এর গড় প্রশস্ততা প্রায় ১০ কিমি। বর্ষা ঋতুতে যমুনার প্রশস্ততা কোন স্থানেই ৫ কিমি-এর কম হয় না।
বাস্তবে যমুনা একটি চরোৎপাদী নদী। কয়েকশত মিটার থেকে কয়েক কিমি প্রশস্ততা বিশিষ্ট বিভিন্ন আকৃতির, এবং বিনুনি, সর্পিলাকৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন প্যাটার্নের প্রবাহখাত নিয়ে যমুনা নদী গঠিত।
বাংলাদেশে অবস্থিত
যমুনার প্রবাহপথের অধিকাংশ স্থানেই অসংখ্য চর গড়ে উঠেছে যেগুলো বর্ষা ঋতুতে ডুবে যাওয়ার ফলে নদীটি একটি একক খাতে পরিণত হয়।
এভাবে শুধুমাত্র প্রশস্ততার কারণে নদীটি বিশ্বের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীতে পরিণত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পৃথক পৃথক প্রবাহখাতগুলির প্রস্থ ও গভীরতার অনুপাত ৫০:১ থেকে ৫০০:১ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে নদীটির নতিমাত্রা ০.০০০০৭৭, যা গঙ্গার সঙ্গে মিলনস্থানের নিকটবর্তী এলাকায় ০.০০০০৫-এ হ্রাস পায়।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী অববাহিকার আয়তন প্রায় ৫,৮৩,০০০ বর্গ কিমি যার মধ্যে ২,৯৩,০০০ বর্গ কিমি তিববতে, ২,৪১,০০০ বর্গ কিমি ভারতে এবং শুধুমাত্র ৪৭,০০০ বর্গ কিমি বাংলাদেশে অবস্থিত। বাহাদুরাবাদের উজানে ব্রহ্মপুত্র ৫,৩৬,০০০ বর্গ কিমি এলাকা নিষ্কাশিত করে থাকে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীপ্রণালী দেশে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত সর্বাধিক প্রশস্ত নদীপ্রণালী। বাহাদুরাবাদে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের প্রবাহ রেকর্ড করা হয়ে থাকে।
পরিমাপকৃত
প্রবাহে বাংলাদেশে প্রবেশকৃত দুধকুমার, ধরলা এবং তিস্তা নদীর প্রবাহ যোগ করা হয় এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও বাঙ্গালী নদীর প্রবাহ বিয়োগ করা হয়ে থাকে।
বর্ষা ঋতুতে যমুনা নদীর প্রবাহ থাকে বিশাল পরিমাণের এবং গড়ে প্রায় ৪০,০০০ কিউমেক।
এই পরিমাণ প্রবাহের দ্বারা নদীটি আমাজন, কঙ্গো, লা প্লাটা, ইয়াংসি, মিসিসিপি এবং
মেঘনার পরেই সপ্তম বৃহত্তম স্থানে অবস্থান করে নিয়েছে। ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে যমুনায় রেকর্ড পরিমাণ প্রবাহ পরিমাপ করা হয় যার পরিমাণ ছিল ৯৮,৬০০ কিউমেক। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার বার্ষিক গড় প্রবাহ প্রায় ৫০১ মিলিয়ন একর-ফুট।
আগস্ট মাসে:
প্রায়ই ব্যাপক বিস্তৃত বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে।
মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সংঘটিত বন্যা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনা নদীতে প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে।
গঙ্গার তুলনায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর প্রবাহ অধিকতর গতিসম্পন্ন। যমুনার গড় নতিমাত্রা ১:১১,৮৫০, গঙ্গার নতিমাত্রার তুলনায় সামান্য বেশি।
বিশাল আয়তনের জলরাশি প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে যমুনা প্রচুর পরিমাণে পলিরাশিও বহন করে থাকে।
বর্ষা ঋতুতে যমুনা নদী দৈনিক প্রায় ১২ লক্ষ টন পলি বহন করে আনে এবং বাহাদুরাবাদে পরিমাপকৃত যমুনার বার্ষিক পলিবহন ক্ষমতা প্রায় ৭৩৫ মিলিয়ন টন।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনার চারটি প্রধান উপনদী রয়েছে: দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা এবং করতোয়া-আত্রাই নদীপ্রণালী।
এদের মধ্যে দুধকুমার, ধরলা এবং তিস্তা নদী তিনটি খরস্রোতা প্রকৃতির এবং ভারতের দার্জিলিং ও ভূটানের মধ্যবর্তী হিমালয়ের
দক্ষিণপার্শ্বে অত্যধিক ঢালবিশিষ্ট অববাহিকা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। শাখানদীসমূহের মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দীর্ঘতম এবং দুইশত বছর পূর্বে এটিই ছিল ব্রহ্মপুত্রের মূল গতিধারা।
যমুনা নদী দ্বারা বিভক্ত
বাংলাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে যমুনা
নদীর উপর সাম্প্রতিক কালে ৪.৮ কিমি দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু নামে অভিহিত এই সেতুর পূর্ব প্রান্ত টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুর উপজেলায় এবং পশ্চিম প্রান্ত সিরাজগঞ্জ জেলার সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত।
সেতুতে বিদ্যমান:
সড়ক ও রেলপথে যাত্রী ও পণ্যের দ্রুত পরিবহণ ছাড়াও সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সঞ্চালন এবং টেলিযোগাযোগ ত্বরান্বিত হয়েছে।
সেতুটি ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
অত্যধিক প্রচরণশীল যমুনা নদীকে সেতু দ্বারা নির্ধারিত খাতে প্রবাহমান রাখার জন্য ব্যাপক নদীশাসন কর্মকান্ড সম্পন্ন করা হয়।
প্রকৃতিগতভাবে যমুনা নদীটি বিনুনি অথবা চরোৎপাদী প্রকৃতির। এর বিনুনি বলয়ের মধ্যে বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য চর বিদ্যমান রয়েছে।
১৯৯২ সালের শুষ্ক ঋতুতে তোলা ল্যান্ডস্যাট ইমেজ (Landsat image) থেকে দেখা যায় যমুনা নদীতে ৫৬টি বৃহদাকৃতির দ্বীপ
বা চর বিদ্যমান রয়েছে যাদের প্রতিটি ৩.৫ কিমি-এর অধিক দীর্ঘ।
বালুময় চর এবং উদ্ভিদ আচ্ছাদিত চরও এই হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৯৭৩ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র মুখের বিপরীত প্রবাহে, সিরাজগঞ্জের উত্তর ও পূর্ব পার্শ্বে এবং গঙ্গার সঙ্গে মিলনস্থলের উজানে যমুনার দক্ষিণতম প্রবাহে নিয়মিত চর গঠন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়েছে।
বিভিন্ন নদীর তীর ভাঙনের কবলে পড়ে ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে প্রায় ৭,২৯,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিল যমুনার তীর ভাঙনের শিকার।
ব্রহ্মপুত্র নদ:
ব্রহ্মপুত্র নদ (Brahmaputra River) পৃথিবীর দীর্ঘতম নদনদীগুলির একটি।
এর অববাহিকা অঞ্চল চীন (তিববত), ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
এর উৎপত্তি শিমায়াঙ-দাঙ হিমবাহ থেকে, স্থানটি (৩১°৩০´ উত্তর এবং ৮২°০´ পূর্ব) পারখা থেকে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটারের মতো দূরে।
পারখা, মানস সরোবর হ্রদ ও কৈলাস পর্বতের মধ্যবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র।
দক্ষিণ তিববতের শুষ্ক ও সমতল অঞ্চলের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নদটি হিমালয়ের ‘নামছা বারওয়া’ চূড়ার সন্নিকটে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
এর উচ্চতা ৭,৭৫৫ মিটার। ভারতের ভূখন্ডে এর প্রধান উপনদীগুলি হলো আমোচু, রেইডাক, সঙ্কোশ, মানস, ভারেলি, দিবাঙ এবং লুহিত।
তিববত ভূখন্ডের একাধিক উপনদী আংশিকভাবে মূল হিমালয় এবং জাঙপোর মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দক্ষিণপশ্চিম তিববতের উৎপত্তি স্থল থেকে ব্রহ্মপুত্রের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ২৮৫০ কিমি।
আসামের হিমালয় অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র দিহাঙ নামে পরিচিত। পূর্ববঙ্গের বিশাল বিস্তৃত সমভূমিতে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র ঐ নামেই পরিচিত।
উত্তরপূর্ব আসামের সাদাইয়া নামক স্থানের কাছে পূর্ব দিক থেকে দিবাঙ এবং লুহিত এর সাথে মিলেছে।
দিবাঙ উপনদী দিহাঙের পূর্ব হিমালয়ের নিষ্কাশন প্রণালী এবং লুহিত আসাম ও মায়ানমারের মধ্যবর্তী অঞ্চলের নিষ্কাশন পরিচালনা করে।
নদ-নদী:
তিববতের সমভূমির মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথটি জাঙপো হিসেবে পরিচিত এবং লাসার দক্ষিণে এর গতি মন্থর।
উৎসমুখ থেকে নামছা বারওয়া-র কাছে কেন্দ্রীয় হিমালয় অঞ্চলে প্রবেশ মুখ পর্যন্ত তিববত ভূখন্ডে নদটির অতিক্রান্ত দৈর্ঘ্য ১৬০০ কিমি।
তিববতে নদটির সঙ্গে তিনটি উপনদী যুক্ত হয়েছে।
এর তলদেশ ভূমির উচ্চতা ত্রাদমে ৪,৫২৩ মিটার, নামছা বারওয়ার কাছে গেইলা সিনডং-এ ২,৪৪০ মিটার, এবং উত্তরপুর্ব আসামের সাদাইয়াতে মাত্র ১৩৫ মিটার।
বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে আসামে এটি বন্ধুর দক্ষিণপশ্চিম দিক থেকে শিলং অধিত্যকার উত্তর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে।
আসামের সমভূমিতে ব্রহ্মপুত্র একটি বিশাল নদ। নদটিতে রয়েছে অসংখ্য দ্বীপ এবং এটি প্রায়শই এর গতিপথ পরিবর্তন করে।
আসাম উপত্যকায় অনুপ্রস্থভাবে ৭২০ কিমি দীর্ঘ গতিপথ অতিক্রমের পরে এটি গারো পাহাড় ঘিরে প্রবাহিত হয়ে
বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং গঙ্গা ও দক্ষিণের সাগরে মেলার পূর্ব পর্যন্ত এর দক্ষিণমুখী প্রবাহের দৈর্ঘ্য ২৪০ কিমি-এর কাছাকাছি। বাংলাদেশে এর প্রবাহ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, যা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত।
নদী পরিচিতি:
প্রকৃতপক্ষে, ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ পূর্বাভিমুখে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল।
১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি রেনেলের মানচিত্রে এভাবেই নদটির গতিপথ চিহ্নিত হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এর তলদেশের উচ্চতা মধুপুর গড়ের ভূ-গাঠনিক আলোড়নের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
সমগ্র নিম্ন ব্রহ্মপুত্র নদ জালের মতো ছড়ানো নদীখাতসমূহের সমন্বয়ে গঠিত, শীত মৌসুমে যা শুষ্ক থাকে কিন্তু বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হয়।
এর অসংখ্য দ্বীপ রয়েছে যা স্থানীয়ভাবে চর নামে পরিচিত। দেশের উত্তর-দক্ষিণ অভিমুখে প্রবাহিত এই নদীপ্রণালীটি সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত। গোয়ালন্দঘাটে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
এই বিশাল:
নদটির প্রভাবিত এলাকার আয়তন ৫,৮৩,০০০ বর্গ কিমি, যার ৪৭,০০০ বর্গকিলোমিটারের অবস্থান বাংলাদেশ এলাকায়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীটি বিনুনি ধরনের। এর প্রধান চারটি উপনদীর নাম দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা এবং করতোয়া-আত্রাই প্রণালী।
প্রথম তিনটি নদী প্রবণতার দিক থেকে খরস্রোতা। ভারতের দার্জিলিং এবং ভুটানের মধ্যবর্তী হিমালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বীয় খাড়া জলধারণ খাত থেকে এদের উৎপত্তি।
ব্রহ্মপুত্রের সকল শাখার মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রই সর্ববৃহৎ, যা ছিল ২০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ।
১৭৮৭ সালের তীব্র ভূমিকম্প ও প্রলয়ংকরী বন্যার পরে নদীটির গতিপথে পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল।
বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র বিশাল আয়তনের পানি অপসারণ করে এবং একই সময়ে এটি প্রচুর পরিমাণ পলিও বহন করে।
নদটির প্রশস্ততা স্থান ভেদে ৩ থেকে ১৮ কিমি পর্যন্ত, তবে গড় প্রশস্ততা ১০ কিমি-এর মতো।
বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের নতিমাত্রা ০.০০০০৭৭ থেকে গঙ্গার সঙ্গে মিলন স্থলের কাছে হ্রাস পেয়ে ০.০০০০৫-তে দাঁড়িয়েছে।
নদটি বছরে প্রায় ৭২৫ মিলিয়ন টন পলি বহন করে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মপুত্র নদ বহু নদীখাত সম্বলিত একটি নদ।
বাংলাদেশ ভূখন্ডে নদীখাতগুলি বহু ধরনের আকৃতিবিশিষ্ট। এসব নদীখাতের প্রশস্ততা কয়েক শত মিটার থেকে কয়েক কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত।
ধরনেও রয়েছে বিভিন্নতা- বিনুনি, সর্পিল, (anastomosed)। ব্রহ্মপুত্র নদে নদীখাতের ধরন নিয়ন্ত্রণে প্রধান প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়টি হলো এর অপসারণ মাত্রা
বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীগুলোর নাম