আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও এর প্রতিক্রিয়া: অতঃপর আইয়ুব-মোনেম চক্র ১৯৬৭ সনের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব বাংলার কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাকিস্তান স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ আনে।
প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করাই ছিল এই মামলার মুখ্য উদ্দেশ্য। সরকার এই ষড়যন্ত্রকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেন।
১৮ই জানুয়ারি প্রেসনোটে শেখ মুজিবকে এই মামলায় জড়ানো হয়।
তাঁর বিরুদ্ধে উক্ত ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়। একে ‘পিণ্ডির ষড়যন্ত্র’ আখ্যায়িত করাই যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ
সেখান থেকে এই ষড়যন্ত্রের নীলনকশার সূত্রপাত। এক নম্বর আসামি শেখ মুজিবসহ মোট ৩৫ জনকে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়।
১১ জনকে রাজসাক্ষী হওয়ায় ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। গল্পের সারাংশ এই হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ‘ভারতীয় যোগসাজশে এবং ভারতীয়
অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছে। এই মামলার প্রধান উদ্দেশ্য
ছিল শেখ মুজিবসহ কয়েকজন সৎ সাহসী বাঙালি অফিসারকে দেশের দুশমনরূপে প্রমাণ করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে পূর্ব
বাংলার স্বার্থ ও প্রগতিবাদী আন্দোলনকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দেওয়া।
এই তথাকথিত মামলা বিচারের জন্য মে মাসে একটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
জুন মাসে বিচার শুরু হয়। বিচারের শুরুতে আসামিরা সকলে নির্দোষ বলে দাবি করে। শেখ মুজিব একে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য
করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিকট থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তাদের উপর অমানুষিক ও বর্বরোচিত অত্যাচার করা হয়। সাক্ষ্য-
প্রমাণে দেখা গেল সম্পূর্ণ মামলাটিই ছিল একটি হীন ষড়যন্ত্র। এই মামলা সাজিয়ে আইয়ুব খান চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
কারণ এই মামলার প্রতিক্রিয়া সরকার যা আশা করেছিল, হয়েছিল তার ঠিক উল্টা। বলাবাহুল্য যে, প্রকৃতপক্ষে এই মামলা আইয়ুবের জন্য
আত্মঘাতী হয় এবং এ তাঁর পতন ত্বরান্বিত করে।
শেখ মুজিবকে এই মিথ্যা মামলায় জড়ানোর জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের মনে দারুণ ক্ষোভ ও অসন্তোষের আগুন জ্বলে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
ছাত্ররা শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। সরকার এই আন্দোলন দমন করার জন্য পুলিশ ই.পি.আর. ও সামরিক
বাহিনীকে মোতায়েন করে। ১৯৬৮ সনের শেষের দিকে এবং ১৯৬৯ সনের প্রথম ভাগে এই আন্দোলন ব্যাপক ও তীব্রতর হয় এবং শেষ
পর্যন্ত গণ- অভ্যুত্থানের রূপ গ্রহণ করে।
১৯৬৮ সনে আইয়ুব খান তার স্বৈরাচারী শাসনের দশ বৎসর পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যা উন্নয়ন দশক বা Decade of Development
নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর শাসনে দেশের উন্নতির স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
পূর্ব বাংলার জনগণ আইয়ুবের এই মহোৎসবে শরিক হতে উৎসাহ বোধ করে না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
কারণ সরকারের নির্লজ্জ ও মিথ্যা প্রচারণার মাহাত্ম্যে জনগণের মন আরও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তারা একে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা মনে
করে। তথাকথিত উন্নয়ন দশকে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। জাতীয় পরিষদে
প্রশ্নোত্তকালে সরকার এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে এই বৈষম্যের সৃষ্টি এবং ক্রমশ
এ বাড়িতে থাকে। ক্রমে ক্রমে পাকিস্তান ২২টি পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অসম উন্নয়ন ও
অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সৃষ্টি পর্যন্ত এড়ায়নি। বিদেশি গবেষকগণ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য এই বৈষম্যের করুণ চিত্রটি প্রকট করে ফুটিয়ে তোলে।